স্বদেশ ডেস্ক:
একটি বনের মধ্যে আবর্জনা দিয়ে ভরে রাখা পরিবেশের জন্য সহায়ক কোনও সমাধান হিসেবে ভাবা হয়না, কিন্তু সেটাই ঘটেছে কোস্টারিকাতে। দেশটির উত্তর অংশের পতিত চারণভূমি গুয়ানাকাস্তে প্রিজার্ভ যেখানে এক হাজারের বেশি ট্রাকে করে ১২,০০০ (বারো হাজার) টন কমলার খোসা এবং কোয়া ফেলা হয়েছিল।
দুই দশক পরে সেখানে ঘটে যায় চমকপ্রদ এক ঘটনা। ২০১৩ সালে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের একটি প্রতিনিধি দল সেখানে ফিরে যায় এবং আবিষ্কার করে যে, সেখানে ১৭৬% জৈবজ্বালানী বৃদ্ধি পেয়েছে। একেবারে বিরান ছিল এমন তিন হেক্টর এলাকা সতেজ রেইনফরেস্ট হিসেবে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।
রসালো চুক্তি!
তো কিভাবে এটি ঘটলো? এটা ঘটার পেছনে ছিল বন সংরক্ষণে নেয়া বৈপ্লবিক এক নিরীক্ষা যদিও তা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৯৬ সাল। সেইসময় জুস প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ডেল ওরোর পানীয় প্রক্রিয়াজাতকরণ শোধনাগার ছিল গুয়ানাকাস্তে সংরক্ষিত বনের পাশেই।
আমেরিকান বন সংরক্ষক ড্যানিয়েল জ্যানযেন এবং উইনি হ্যালওয়াচ, দুজনেই পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির বাস্তুবিদ্যা বিশেষজ্ঞ এবং কোস্টারিকার পরিবেশ বিষয়ক কর্তৃপক্ষের পরামর্শক হিসেবে কাজ করার সময় ডেল ওরোকে প্রস্তাব দিলেন যে, তাদেরকে একটি বিস্তীর্ণ এলাকার ভূমি দান করা হোক। বিনিময়ে কোম্পানিটির ব্যবহৃত কমলার খোসা এবং কোয়া সংরক্ষিত বনের পতিত চারণভূমিতে ফেলার অনুমতি দেয়া হবে।
এই ধরনের আবর্জনার একটা সুষ্ঠু বিহিত করা ছিল প্রতিষ্ঠানটির জন্য সাধারণভাবে একটি সঙ্গত মাথাব্যথার কারণ। জ্যানযেন এবং হ্যালওয়াচ-এর একটি পরিকল্পনা ছিল: তাদের বিশ্বাস ছিল যে, এই ফলের আবর্জনা থেকে বায়োডেগ্রেডেশনের মাধ্যমে রেইনফরেস্ট পুনর্জীবন পেতে পারে এবং তাদের ভাবনা ছিল একবারে সঠিক।
চমকপ্রদ ফলাফল
কমলার খোসা দ্বারা আবৃত জমি এবং খোসা ছাড়া জমির মধ্যে তুলনায় দেখা যায়, কমলার আবর্জনা সার হিসেবে কাজ করেছে। আরও জৈব জ্বালানী সাথে সাথে, “আবর্জনার স্তূপগুলি” সমৃদ্ধ মাটি, প্রচুর প্রজাতির গাছপালা এবং পেয়ে গেল আরও নিবিড় ক্যানোপি (বনের মধ্যে বড় বড় গাছের ওপরের অংশ একে অপরের সাথে জড়িয়ে একটা আচ্ছাদন-এর সৃষ্টি করে যার মধ্য দিয়ে যে সূর্যের আলো মাটিতে পৌঁছতে পারেনা) তৈরি করে। উদ্দেশ্য খুব সাধারণ, এলাকাটিকে আরো সবুজ রাখা।
কমলার আবর্জনা হুমকিতে থাকা বনগুলোর জন্য বেশ সস্তা এবং আরও কার্যকর উপায় বের করে দিল। এর ফলাফল এমনকি এতটাই চমকপ্রদ হয়ে উঠলো যে গুয়ানাকাস্তে প্রকল্প শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তা বন্ধ হয়ে যায়!
১৯৯৮ সালে ডেল ওরো এবং এসিজি গ্রুপের মধ্যে অংশীদারিত্বকে আইনগত-ভাবে চ্যালেঞ্জ করে টিকোফ্রুট নামে প্রতিদ্বন্দ্বী একটি পানীয় তৈরির প্রতিষ্ঠান। তারা ডেল ওরো সহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় উদ্যানকে “অপরিচ্ছন্ন” করার অভিযোগ আনে। ২০০০ সালে সুপ্রিম কোর্ট ডেল ওরো এবং পরিবেশ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের স্বাক্ষরিত চুক্তিকে অবৈধ বলে রুল জারি করে।
জ্যানযেন এবং হ্যালওয়াচ-এর পরিকল্পনা বাজিমাত করলেও, তারা কখনোই তা উদযাপন করার মত মানসকিতায় ছিলেন না।। এই দুই মার্কিন বিজ্ঞানী এই প্রকল্পকে দেখলেন, সামগ্রিকভাবে রেইনফরেস্ট বা চির হরিৎ অরণ্যকে টেকসই করার সুযোগ হিসেবে।
মাটির নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে, কমলার আবর্জনা ফেলে দেয়ার দুইবছর পরই জমিটি উল্লেখযোগ্য-ভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। আজকের দিনে জায়গাটি খুবই স্বাস্থ্যবান তরতাজা অল্পবয়সী বৃক্ষের বনে পরিপূর্ণ, সেখানে যে জায়গাগুলো এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়নি সেখানে সেই এক শতাব্দী বা তারও বেশি সময় ধরে সেই পুরনো ক্লান্ত চারণভূমি বিরাজ করছে-এমনটাই বলেন জ্যানযেন।।
কিন্তু এটা কিভাবে কাজ হলো?
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী টিমোথি ট্রিওয়ের যিনি ২০১৩ সালের সফরের নেতৃত্বে ছিলেন, তিনি বলেন, “এই ধরনের প্রক্রিয়া একইসাথে অনেক সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে ঘাস এবং আগাছা নিংড়ে এবং মাটিকে সমৃদ্ধকরণে পারে।
দেশীয় গাছগুলি যার কিনা একটা সময় পা রাখার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছিল তারাও তুলনামূলক অনেক অনুকূল পরিবেশে নতুনভাবে শুরুর সুযোগ পেল। এই প্রক্রিয়াটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সহজ ও সস্তা ছিল। “মূলনীতি মারাত্মক সহজ: একটি পুষ্টি সমৃদ্ধ বর্জ্য প্রবাহ-ধারা খুঁজে বের করতে হবে , ডি-গ্রেডেড জমি খুঁজে বরে করতে হবে যেখানে পুনর্বনায়ন থেমে আছে ।
বিজ্ঞানী ট্রিওয়ের বলেন, ক্রান্তীয় বন পুনরুদ্ধার প্রায়শই ব্যয়বহুল। কৃষি এবং অন্যান্য খাতগুলো সেখানে প্রায়ই বিশাল পরিমাণে পুষ্টি সমৃদ্ধ উৎপাদন দেয় অথবা অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ ব্যয়সাপেক্ষে প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রয়োজন হয়।
যখন এই অভিজ্ঞতার উত্তরাধিকারের প্রশ্ন আসে, জ্যানযেন এর কণ্ঠস্বর আর ইতিবাচক সুর ছিলনা। যেকোন প্রকল্প টেকনিক্যালি প্রচণ্ড ভালো হতে পারে কিন্তু এইসব বা সেইসব সামাজিক উপাদানের ইচ্ছায় ধ্বংস হয়ে গেছে, বলেন জ্যানযেন। প্রকৃতির টেকনিক্যাল বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা অনেকসময়ই সমাধানযোগ্য তবে যদি তার সমাধান করতে সুযোগ দেয়া হয়।
পুনর্বনায়নের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হুলো একটা সমাজের উপস্থিতি যারা চায় যে এর পুনর্বনায়ন হোক। মনে রাখতে হবে, একটা কারণে এসব কিছুই বাদ দিতে হয়েছিল। বনের পুনর্জীবনের জন্য এইসব কারণ বাতিল করতে হবে। এই বিষয়ে বিবিসির পক্ষ থেকো টিকো ফ্রুট কোম্পানির সাথে প্রতিক্রিয়ার জন্য যোগাযোগ করা হলে তারা কোনও সাড়া দেয়নি।
মূল মামলায় এই কোম্পানি আরেকটি কারণ তুলে ধরে গুয়ানকাস্তে চুক্তির বিরুদ্ধে: তাদের বিবেচনায় এটা অন্যায্য যে, ডেল ওরো কে কোনে বর্জ্য নিষ্কাশন কেন্দ্র নির্মাণ করতে বাধ্য করা হয়নি যেমনটা করা হয়েছিল নব্বইয়ের মাঝামাঝিতে টিকোফ্রুটকে, তাদের কমলার বর্জ্য নদী দূষণ করছে এই অভিযোগে।
টিকোফ্রুট আরও দাবি করে যে, ডেলওরো কোম্পানির বর্জ্য মাটি এবং গুয়ানাকাস্তের নিকটবর্তী নদীকে বিষাক্ত করে তুলছে । পাশাপাশি সাইট্রাস পোকার জন্য ভয়াবহ প্রজনন ক্ষেত্রে তৈরি করছে তবে এমন অভিযোগ খারিজ করে দেন জ্যানযেন।
মামলা-মোকাদ্দমা
একজন বিশেষজ্ঞের নির্দেশনা মোতাবেক প্রতিযোগী টিকোফ্রুট কোম্পানির দ্বারা মামলা করা হয়েছিল, জানান ড্যানিয়েল জ্যানযেন। হতাশা ট্রুরে কণ্ঠেও।
“একজন বিজ্ঞানী হিসেবে এটা হতাশাজনক যখন বড় বড় চ্যালেঞ্জের সম্ভাবনাময় সমাধানগুলোকে সঙ্কুচিত করা, ছেঁটে ফেলা কিংবা এড়িয়ে যাওয়া হয় অজানা উদ্বেগের অজুহাতে, বিশেষ করে যখন এইসব ভুল তথ্যসমৃদ্ধ কর্পোরেট স্বার্থসিদ্ধি থেকে উঠে আসে।
তারপরও এই বিজ্ঞানী এই প্রকল্পের সীমিত সাফল্যের মাঝেও সান্ত্বনা খুঁজে নিচ্ছেন। ট্রিওয়েয়ার উপসংহার টানেন এই বলে যে, এই ব্যবস্থাটির নূন্যতম প্রক্রিয়াজাত হওয়ার আশাবাদের জন্য সেখানে প্রথম যে নীতিগত কারণ উল্লেখ করা যায় তা হল- গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন পুনরুদ্ধার করতে হলে কৃষিজাত বর্জ্য ব্যবহার করা যেতে পারে। সূত্র : বিবিসি।